
মূল প্রবন্ধটি দেখতে ক্লিক করুন
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের আয়োজনে ‘কন্যাশিশুদের সার্বিক অবস্থা: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ২০২১-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন এবং কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণ-২০২৩ উপস্থাপন। আজ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ সকাল ১১.০০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে (জহুর হোসেন হল) ‘কন্যাশিশুর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে । কন্যাশিশুদের যথাযথ বিকাশে তাদের প্রতি বিনিয়োগ বৃদ্ধি আবশ্যক: ড. বদিউল আলম মজুমদার
বাংলাদেশে কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা এক নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সকল ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা-সহ কন্যাশিশুদের কল্যাণে একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরেছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। আজ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম-এর আয়োজনে এবং এডুকো বাংলাদেশ ও গুড নেইবারস বাংলাদেশ-এর সহযোগিতায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উক্ত সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়। জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্র্রেক্ষাপটে ফোরাম কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কন্যাশিশুদের সার্বিক অবস্থা-২০২১-২০২২ (Status of Girl Children 2021-22) শীর্ষক এক প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন করা হয় এবং কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণ-২০২৩ তুলে ধরা হয়। উলেখ্য, Status of Girl Children 2021-22 প্রতিবেদনটি শুধু কন্যাশিশুদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রণীত প্রথম প্রতিবেদন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম-এর সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার, ফোরাম সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি, গুড নেইবারস বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মাঈনুদ্দিন মাইনুল, সেভ দ্য চিল্ড্রেন-এর ডিরেক্টর ড. লিমা রহমান, চাইল্ড রাইটস ¯েপশালিস্ট অ্যান্ড অ্যাক্টিভিস্ট টনি মাইকেল গোমেজ এবং এডুকো বাংলাদেশ-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিগত সময়ে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার নানামুখী উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশুরা অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু তারা এখনও নানান ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে নারী ও কন্যাশিশুরা ভালো নেই। আমরা মনে করি, কন্যাশিশুদের যথাযথ বিকাশ ও তাদের জন্য সুযোগ নিশ্চিত করা না হলে জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে না। তাই তাদের বিকাশের জন্য তাদের প্রতি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।’ কন্যাশিশুদের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার ভিত্তিতে কন্যাশিশুদের বর্তমান অবস্থা নির্ণয় করা যাবে এবং এর ভিত্তিতে তাদের উন্নয়নে অগ্রাধিকার নির্ণয় করা যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফোরাম সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, ‘কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা আমাদের দেশে এক নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদেরকে দুইভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। একদিকে সামগ্রিকভাবে সমাজের নিপীড়িতদের একজন হিসেবে, অন্যদিকে কেবল নারী হওয়ার কারণে, যাকে লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন বলা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সারাদেশের থানায় বিগত পাঁচ বছরে (২০১৮-২২) ২৭ হাজার ৪৭৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৬০টি। এর মধ্যে ২০২২ সালে সারাদেশে চার হাজার ৭৬২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। একই বছর নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৯ হাজার ৭৬৮টি।’
তিনি বলেন, ‘কন্যাশিশুদের প্রতি বঞ্চনার শুরু হয় তার জন্মলগ্ন থেকেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্রƒণাবস্থা থেকেই। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, নির্যাতনের ক্ষেত্রে নির্যাতিত কন্যাশিশু বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও, সে তুলনায় অভিযুক্তদের আটক হওয়া,ক্ষেত্রে শাস্তি পাওয়া বা ন্যায়বিচার পাওয়ার সংখ্যা নেই বললেই চলে। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য নির্যাতন ও সহিংসতা দিন দিন ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম হচ্ছে এবং অপরাধীরা ক্রমাগত উৎসাহিত হচ্ছে অপরাধমূলক কার্যক্রম করতে।’
কন্যাশিশুদের প্রতি বিভিন্ন মাত্রায় এবং বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিগত ৮ মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট ২০২৩) মোট ৩২৯ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই সময়কালে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৩০ জন কন্যাশিশু। অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হয়েছে ২ জন কন্যাশিশু, অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ১০৪ জন কন্যাশিশু। এ সময় দেশের ২৩টি জেলার ৫২টি উপজেলার ১৩৬টি ইউনিয়নে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিবাহ হয়েছে ২৬০ জন কন্যাশিশুর এবং বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে ২১ জনের। বিগত ৮ মাসে মোট ৪৯৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া ১০১ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৩২২ জন, গণধর্ষণের শিকার হয় ৭২ জন কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু রয়েছে ৩৯ জন। আশার বিষয় হলো, ৬৪৯টি অপরাধের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন অভিভাবকরা। তবে ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিচারের জন্য কেবল মামলা দায়ের করা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অল্পসংখ্যক আটক এবং পরবর্তীতে জামিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিচার প্রক্রিয়া। চ‚ড়ান্ত শাস্তির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
নাছিমা আক্তার জলি বলেন, ‘বিগত ৮ মাসে গৃহশ্রমিক নির্যাতনের মোট ২৬টি তথ্য পাওয়া গেছে, এ সময় ৩৬ জন কন্যাশিশু নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, ১৮১ জন কন্যাশিশু বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, ১৩৬ জন কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ১১ জন কন্যাশিশুকে বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে, ৩০৭ জন শিশু পানিতে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে,সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছে ২৭ জন শিশু।’
সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সুপারিশগুলো হলো: ১. শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সকল ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে; ২. উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে সর্বস্তরের জন্য ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে; ৩. কারা হেফাজতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে ঘটনার শিকার নারী ও কন্যার পরিবর্তে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে এ ঘটনা ঘটায়নি, এসম্পর্কিত প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করতে হবে; ৪. কন্যাশিশুদের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক থেকে তাদেরকে রক্ষা করা প্রয়োজন। এজন্য পর্নোগ্রাফিক সাইট বন্ধ করতে হবে, কোনো কন্যাশিশু যাতে পর্নোগ্রাফির শিকার না তা নিশ্চিত করতে হবে, সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে; ৫. কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে; ৬. শিশু সুরক্ষায় শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠন করতে হবে; ৭. সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাজেট বৃদ্ধি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কন্যাশিশু ও তাদের অভিভাবকদের এর আওতায় আনতে হবে; ৮. বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারী বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে; ৯. ক্রমবর্ধমান কন্যাশিশু ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে; ১০. কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতারোধে তরুণ-যুবসমাজকে সচেতনকরণ সাপেক্ষে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত করতে হবে।’