২/২, ব্লক-এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
৮৮০-২-৮৮০-২-৯১১

পত্রিকায় প্রকাশিত

বিয়ের বয়স

নাছিমা আক্তার জলি মানসিক পরিপকস্ফতা না আসার কারণে শিশুবিবাহের শিকার হওয়া একজন কিশোরী বধূকে স্বামীর সংসারে নানা ধরনের গঞ্জনা সইতে হয়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় যৌতুকসহ নানা অন্যায় দাবিতে শারীরিক নির্যাতন। এর ফলে সম্ভাবনাময় কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে ওঠা ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই শিশুবিবাহ শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। শিশুবিবাহ কন্যাশিশুকে শিক্ষার অধিকার থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করে। আইসিডিডিআরবি এবং পল্গ্যান বাংলাদেশের যৌথ জরিপ-২০১৩ অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে ১৮ বছরের আগে বিবাহের শিকার হওয়া শিশুর ৮৬ ভাগই নিরক্ষর। ৭৭ ভাগ কন্যাশিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পরপরই শিশুবিবাহের শিকার হয়। শিশুবিবাহ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে মা ও তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের ওপর। শারীরিক ও মানসিকভাবে অপ্রস্তুত শিশুমাতার সন্তান জন্মদানে অধিক পরিমাণে ঝুঁকি দেখা দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারণজনিত নানা সমস্যা_ যেমন, অবস্ট্রেটিক ফিস্টুলার শিকার হতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীর তুলনায় ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীর মৃত্যুঝুঁকি থাকে পাঁচগুণ বেশি। যেখানে বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এক রোলমডেল তথা একটি ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে, সেখানে কিশোরী নির্যাতনের মূল কারণ শিশুবিবাহ রোধে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পল্গ্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও আইসিডিডিআরবি পরিচালিত ‘বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ’ সংক্রান্ত জরিপ প্রতিবেদন (২০১৩ সাল) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ কন্যাশিশু ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই শিশুবিবাহের শিকার হয়। এ অবস্থায় এমডিজি ও এমডিজি-পরবর্তী এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনের লক্ষ্যে শিশুবিবাহ রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। আমরা যারা কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষার আন্দোলনে কাজ করছি তারা দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছি যে, ১৯২৯ সালে প্রণীত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন শিশুবিবাহ প্রতিরোধে অনেকটাই ব্যর্থ। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। আমরা সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৪’ নামে একটি আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় পাসও হয়েছে। আইনে শিশুবিবাহের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ কারাভোগের মেয়াদ তিন মাসের জায়গায় দু’বছর করা হয়েছে। জরিমানা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে কনের বয়স ১৬ বছরের কম হলে এবং বরের বয়স ১৮ বছরের কম হলে তা বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য হবে এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের (অনুশাসন) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রস্তাবে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। কারণ বিবাহের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত এই বয়স জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের লঙ্ঘন, যে সনদে ১৮ বছরের নিচে সবাইকে শিশু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষরদাতা দেশ। শুধু তাই নয়, শিশু আইন ২০১৩ ও জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়েছে। বিবাহের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত এই বয়স ১৬ হলে তা হবে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিবাহের বয়স নির্ধারণে মন্ত্রিসভার প্রস্তাব পাস হলে তথা আইনে পরিণত হলে নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিসহ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা অপরিণত গর্ভধারণ, শিশুর পুষ্টিহীনতা, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, ঝরে পড়ার হার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের বয়স ১৬ বছর নির্ধারণ করা হলে বাংলাদেশ সরকারের বিগত বছরগুলোতে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তথা নারী শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে যে ধারাবাহিক সাফল্য তা অনেকটাই পিছিয়ে যাবে। তাই শিশুবিবাহ বন্ধের জন্য বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাব কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকার যেখানে কন্যাশিশুর বিবাহকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করে এ সমস্যা দূরীকরণে বিভিন্ন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জনমত গঠন, বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তভর্ুুক্তকরণ ও শিশুবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বিয়ের বয়স কমিয়ে আনা হলে পরোক্ষভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুবিবাহকেই উৎসাহিত করা হবে। তাই শিশু আইন ২০১৩-এর আলোকে কন্যাশিশুর স্বার্থে তথা জাতীয় স্বার্থে মন্ত্রিপরিষদের এই প্রস্তাব বাতিল করে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য নূ্যনতম ১৮ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। সম্পাদক, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম http://www.samakal.net/2014/10/13/91572

বাল্যবিবাহ রোধে কন্যাশিশু ফোরামের কার্যক্রম

-নাসিমা আক্তার জলি
সাক্ষাতকার – ফোরাম সম্পাদক, ‘কন্যাশিশুদের সুরক্ষায় সরকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়’