২/২, ব্লক-এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
৮৮০-২-৮৮০-২-৯১১

বাল্য বিবাহ নয় নয় বেশি ব্যবধানে বিয়ে

07-11-12
logo-ittefaq
লেখক: রাবেয়াবেবী  |  বুধবার, ৭ নভেম্বর ২০১২, ২৩ কার্তিক ১৪১৯
‘কন্যা শিশুর বিয়ে রোধ করুন’ শ্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে জাতিসংঘ এ বছর ১১ অক্টোবর প্রথমবারের মতো পালন করেছে ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ডে অব গার্ল চাইল্ড’ বা কন্যা শিশু দিবস। কন্যা শিশুর প্রতি মূল্যবোধ, সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌন হয়রানি বন্ধ, প্রতিহিংসা দুরীকরণ, অধিক বয়সের ব্যবধানে বিয়ে করে দাম্পত্য অশান্তি সৃষ্টি রোধসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ইস্যুতে কাজ করার লক্ষ্যে পাঁচ বছরব্যাপী ‘প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল’-এর বিকজ আই অ্যাম আ গার্ল (বিয়াগ) এই আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন করে, একযোগে বিশ্বের ৬৪ দেশে উদযাপিত হয়। বাংলাদেশেও পালিত হয় এই দিবস। সেদিন পাঁচজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। তারা হলেন— ফাহমিদা নবী, মুন্নি সাহা, সালমা খাতুন, কানিজ আলমাস খান এবং নিশাত মজুমদার। বাল্য বিবাহের কুফল নিয়ে এই পাঁচ নারী জানান তাদের মতামত। তাদের সাথে কথা বলে আজকের মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন— রাবেয়া বেবী

বয়সের ব্যবধানে বিয়ের পর দেখা দেয় দাম্পত্য কলহ

— কানিজ আলমাস খান

বিউটি এক্সপার্ট

আমাদের দেশে বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য থাকে অনেক। এই বয়সের পার্থক্যের কারণে যে শুধু মেয়েটির জীবনে অন্তহীন সমস্যা নিয়ে আসে তা নয় ,বরং দাম্পত্য জীবনে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। আমি এমন অনেক সমস্যার কথা বলতে পারবো। শুধু গ্রামেই যে বয়সের অনেক ব্যবধানে বিয়ে হচ্ছে তা নয় শহরেও এটি ঘটে। একটি উচ্চ শিক্ষিত ছেলে চাকরি পেয়ে নিজে গুছিয়ে বিয়ে করতে যায় তখন তার বয়স ৩৩ থেকে ৩৫ বছর হয়ে যায়। আমাদের সমাজে অনেক পরিবার মনে করে একটি শিক্ষা শেষ করা বা চাকরিজীবী ২৭ থেকে ৩০ বছর বয়সের মেয়ের চেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক বা ডিগ্রি পড়া মেয়ে হলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। আমি আপত্তিটা যানাচ্ছি এখানেই। বিয়ের মতো একটি সুন্দর সম্পর্ক কেন প্রভাব খাটানোর মনোভাব নিয়ে শুরু হবে? তারা ভাবে না বয়সের পার্থক্যের কারণে ঐ স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে অভিজ্ঞতা, মানসিক চিন্তা ভাবনা আর আবেগের যে দূরত্ব থাকে তা থেকে সংসারে অশান্তি, সংসার ভেঙ্গে যাওয়া এবং পরকীয়াসহ নানান সমস্যা হতে পারে। মেয়েটি পারে না তার দাম্পত্য জীবন ও মাতৃত্বকে উপভোগ করতে। যে সংসারে কানায় কানায় সুখ থাকার কথা সে সংসার হয়ে অশান্তির স্থল। ধর্মেও অনেক বয়সের ব্যবধানে বিয়ে মানা করা হয়েছে।

০০০০০

অসময়ে বিয়ে করার জন্য বোঝা হয়ে

যায় নারী

— মুন্নী সাহা

সাংবাদিক

অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় আমাদের নারীরা স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায়। গ্রামের নারীদের নিয়ে আমি ‘কানেটিং বাংলাদেশ’ নামের একটি অনুষ্ঠান করি। সেই অনুষ্ঠানে ৩০/৩২ বছর বয়সের নারীরা সময়ের অনেক আগে সন্তান জন্ম দেয়ায় জরায়ু নিয়ে নানা সমস্যায় ভোগে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় কারো জরায়ু নিচে নেমে যায়, ইনফেকসন হওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। তারা

এই সকল রোগে এতটাই অসহায় হয়ে পড়ে যে, লজ্জা ভুলে গিয়ে সমস্যা নিয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলে।

অথচ প্রান্তিক নারীদেরই এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে  রক্ষণশীল হওয়ার কথা। আমি মনে করি ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়স একটি মানুষের জন্য সুবর্ণ সময় কাজ করার জন্য, নিজে এগিয়ে গিয়ে সাফল্য অর্জন করা এবং দেশের দশের জন্য কিছু করা। অথচ শুধুমাত্র অসময়ে বিয়ে করার জন্য নিজের দায়িত্ব নিতে পারে না, বোঝা হয়ে যায়। আজকাল শহরেও  ভাল ছেলে পেয়ে গেলে মা-বাবা উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা ডিগ্রি  পড়া মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেন। পরে ভাল ছেলে হাত ছাড়া হয়ে যাবে। সেই ভালে ছেলের আশায় মেয়ের জীবনটাই নষ্ট হয়ে যায়।

০০০০০০০০০০

বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে চলছে কন্যা ভ্রুণ হত্যার প্রতিযোগিতা

— ফাহমিদা নবী

সঙ্গীত শিল্পী

আমাদের দেশে কন্যা শিশুর দিক দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়টি এখন খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। সম্পত্তিতে মেয়ে অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে চলছে টানাপোড়ন। ছেলে  হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট। আরও বলা হয় একটি হলে আর নয়। কিন্তু সম্পতিই একটি সন্তান যখন মেয়ে হয় তখন তাকে হত্যা করতে বাধ্য করে। বর্তমান সময়ে বিশ্ব জুড়ে চলছে কন্যা ভ্রুণ হত্যার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া দরকার আর এজন্য দরকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। আমরা দেখি একজন কন্যা সন্তান তার বাবা-মা’র বৃদ্ধ বয়সে যতটা তাদের প্রতি সংবেদনশীল হন ততটা পুত্র সন্তানরা হতে পারে না। এমন অনেক বৃদ্ধাকে আমি বলতে শুনেছি— ছেলের বউ ভাত দেয় না। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছেলে শিশুর জন্য তারই বেশি আগ্রহ ছিলো। এমন অনেক ভুল ধারনা আমাদের সমাজে প্রচলিত যে, মা-বাবা মেয়ের বাড়িতে থাকতে পারবে না কিন্তু অনেক আধুনিক মেয়ে জামাই নিজের বাবা-মা’র মতো করে শ্বশুড়-শ্বশুড়িকে নিজের বাড়িতে রাখে। সে ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে তাদের মেয়ের। তাই সম্পত্তিতে কন্যা শিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত হলে অনেক সমস্যার যেমন সমাধান হবে। তেমন বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা শান্তিতে থাকবে।

০০০০০০০০

যেকোন সময় তার সংসারে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে

— নিশাত মজুমদার

এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম বাঙালি নারী

শিক্ষা একজন মানুয়ের জীবনে মুক্তি এনে দিতে পারে, আনতে পারে সাফল্য। কিন্তু যখন একটি মেয়ের শিক্ষার মাঝপথে তাকে বিয়ে দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়, তখন সে যেমন জীবনে মুক্তি পায় না, তেমনি পায় না তার পরিবার। একটা মেয়ে শিক্ষিত হলে পুরো জাতি শিক্ষিত হবে এমনটিই বলেছেন নেপোলিয়ান। আমরা জানি তিনি যথার্থই বলেছেন, কিন্তু আমরা তা মানি না। তাই তো একটি মেয়ের শিক্ষা পূর্ণ হওয়ার আগে তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারের মতো বড় একটি বিষয় তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেই। সে পারে না তার আবেগ-অনুভূতি আর শিক্ষা দিয়ে সংসারের হাল ধরতে, পারে না শিশুর যত্ন করতে কারন তার তা জানা নেই। উপরুন্তু যেকোন সময় তার সংসারে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, পারে তার স্বামী মারা যেতে কিংবা অক্ষম হতে। তখন অল্প শিক্ষিত হওয়ায় সে মানসম্পন্ন চাকরি করে সংসারের দায়িত্ব নিতে পারে না। অনেক সম্পদের চেয়ে শিক্ষা মূল্যবান। আমাদের এই দিকগুলো আবশ্যই ভেবে দেখা উচিত্। তাই বাবা-মা’র উচিত্ তাদের কন্যা অন্ততপক্ষে স্নাতক সম্পন্ন করলে বিয়ে দেয়া। স্নাত্তোকত্তর হলে তো কথাই নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক  শিক্ষিত মেয়ে, স্ত্রী, বউ এবং মা যেভাবে সংসারের দায়িত্ব নিবে অপ্রাপ্ত বয়সের অর্ধশিক্ষিত মেয়ে, স্ত্রী, বউ এবং মায়ের পক্ষে তা কখনোই করা সম্ভব না।

০০০০০০০

নারীর আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে আয় করা জরুরী

— সালমা খাতুন

জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের দলনেতা

একটা মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেলে সে যেমন পড়াশুনা করতে পারে না, তেমন অন্য কোন কাজেও দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। ফলে তার জীবনে আসে না অর্থনৈতিক মুক্তি। আমি ক্রিকেট খেলে যা আয় করি তা দিয়ে আমার পরিবার চলে। পরিবারে আমার মা, ভাই আর আমি আছি। আমি যদি অল্প বয়সে বিয়ে করতাম তাহলে সংসারের হাল ধরতে পারতাম না। কারণ যে কোন কাজ করতে গেলে সে কাজ আগে ভালো করে শিখে নিতে হয়। আমার খেলোয়াড় হওয়ার পেছনে অনেক চড়াই-উত্ড়াই আছে, আছে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ। সব কিছুর পরেই আজ আমি সালমা, জাতীয় দলের দলনেতা। আমি যেমন স্বপ্ন দেখছি নিজেকে নিয়ে, তেমন আমাকে নিয়ে দেশও স্বপ্ন দেখছে। এসবই সম্ভব হয়েছে অধ্যাবসায়ের কারনে। আমার বন্ধুদের মধ্যে দু’একজনকে দেখেছি যারা অল্প বয়সে বিয়ে করে সংসারের নানা জটিলতায় হাপিয়ে উঠছে। আমাদের সমাজে এমন উদাহরণ অনেক আছে। আমি বিশ্বাস করি নারীর শিক্ষা আর কর্মদক্ষতা অর্জনের পর বিয়ে হলেই সমাজের চিত্র বদলাবে। কারণ নারীর অত্মসম্মান আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্যই আয় করা জরুরী। একজন মানুষের বেচে থাকতে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। একজন মানুষ হিসেবে নারী শিক্ষা সম্পূর্ণ না করে বিয়ে করলে জীবন যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে না।

তথ্যসূত্র: ইত্তেফাক, ৭ নভেম্বর ২০১২